...

ম্যালেরিয়া রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

গরমের সময় মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। সাথে সাথে বাড়ে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি। ম্যালেরিয়া পরজীবীবাহী জীবননাশক রোগ। প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে এ সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য মানুষ মারা যায়। আমাদের দেশের পার্বত্য জেলায় এ রোগ ব্যাপক হারে দেখা দিলেও মশার কামড়ে যে কারও হতে পারে প্রাণঘাতি রোগটি। আসুন জেনে নিই রোগটির লক্ষণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা সম্পর্কে।ম্যালেরিয়া

ম্যালেরিয়া রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

ম্যালেরিয়ার প্রধান কারণ:
ম্যালেরিয়া হচ্ছে মশাবাহিত প্লাজমোডিয়াম পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ। রোগটি কেবলমাত্র সংক্রমিত স্ত্রী অ্যানোফেলিস মশার কামড়েই হয়ে থাকে। এ পর্যন্ত অনেক প্রজাতির ম্যালেরিয়া পরজীবী আবিষ্কার হলেও মানুষের ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী মাত্র ৪টি প্রজাতি। জীবাণু বহনকারী মশা প্লাজমোডিয়াম ভাইভাক্স, ফ্যালসিপ্যারাম, ম্যালেরি ও ওভাল-এর যেকোনো একটির সংক্রমণে ম্যালেরিয়া হতে পারে তবে প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়ার জটিলতা সবচেয়ে বেশি। সংক্রমিত মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে উক্ত ব্যক্তির রক্তে জীবাণু প্রবেশ করে এবং ব্যক্তিটি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর আক্রমণে মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয় যা প্রাণসংহারী হতে পারে।

ম্যালেরিয়ার লক্ষণ সমূহ:
এই রোগের প্রধান লক্ষণ্ হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা। এই জ্বর সাধারণত ১০৫-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে। এ প্রকার জ্বরে নিয়মিত ও নির্দিষ্ট বিরতিতে জ্বর আসা-যাওয়া করে। সাধারণত এতে একদিন পরপর জ্বর আসে এবং কখনও যা তিন চার ঘণ্টা লম্বা হয়ে থাকে এবং তারপর ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায়। অনেক সময় জ্বর ছেড়ে গেলেও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়েও কমে যায়। এ ছাড়া মাঝারি থেকে তীব্র কাঁপুনি বা শীত শীত অনুভত হওয়া সহ গায়ে ও মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে। অনান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে মাথাব্যথা, অনিদ্রা, খাবারের প্রতি অনাগ্রহ বা ক্ষুধামন্দা, বমিবমি ভাব, হজমে গোলযোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য, খিঁচুনি হতে পারে। ম্যালেরিয়া হলে রোগীর তলপেটে ব্যথা অনুভব হওয়া সহ অধিক ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব হয় এবং তাঁর অনেক পিপাসা লাগতে পারে। লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হওয়ার কারণে রোগীর অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। ম্যালেরিয়া রোগের জটিলতম ধরন হলো ‘ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া’ যাতে সাধারণ ম্যালেরিয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের জটিলতা যেমন রক্তশূন্যতা, কিডনি বৈকল্য, শ্বাসকষ্ট হওয়া, জন্ডিস, খিঁচুনি, রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। জরুরিভাবে চিকিৎসা না করলে এসব রোগী অজ্ঞান হয়ে মারাও যেতে পারে।

পড়ুন  সর্দি কাশি দূর করার প্রাকৃতিক উপায়

ম্যালেরিয়া রোগ নির্ণয়ের উপায়:
ম্যালেরিয়া নির্ণয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে রক্তের মধ্যে ম্যালেরিয়ার জীবাণু আছে কিনা তা খুঁজে বের করা। ম্যালেরিয়া হয়েছে এরুপ সন্দেহ হলেই রোগীর রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত তবে তা অবশ্যই ওষুধ শুরু করার আগে করতে হবে। ম্যালেরিয়া সন্দেহ হলে প্রথমবার পরীক্ষায় যদি ম্যালেরিয়ার কোন কিছু আলামত না পাওয়া যায়, তাহলে পর পর তিন দিন পরীক্ষাটি করতে হবে। আর যদি ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয়, তাহলে উদ্বিগ্ন না হয়ে ও দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এই পরজীবী সাধারনত মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে রক্তের ব্লাড ফিল্ম পরীক্ষা দ্বারা জীবাণু শনাক্ত করা হয়। তবে ম্যালেরিয়ার এন্টিজেন পরীক্ষা করেও রোগটি সনাক্ত করা হয় যাতে সময় কম লাগে।

ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা :
রোগটির চিকিৎসা নির্ভর করে রোগী কি ধরনের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে তার উপর। আর জীবাণু দ্রুত শনাক্তকরণ চিকিৎসার প্রধান উপায়। এ রোগ হলে ডাক্তারগণ ক্লোরোকুইন জাতীয় ঔষধ দিয়ে থাকেন যা এ পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ। তবে ঔষধ খাওয়া শুরু করারার পর ঔষধের পুরো কোর্স খাওয়া উচিত। তাই ম্যালেরিয়ার জটিলতা দেখা দিলেই অতিসত্বর চিকিৎসা শুরু করে দিতে হবে। এমন হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা করা উচিত যেখানে সব রকম সুব্যবস্থা রয়েছে।

পড়ুন  জেনে নিন ডায়াবেটিস নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারনা সম্পর্কে

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের উপায়:
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এ রোগ সম্পূর্ণ প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। মশা থেকে বেঁচে থাকা অর্থাৎ মশার কামড় থেকে দূরে থাকাই এ রোগ প্রতিরোধের প্রধান উপায়। মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে নিচের কাজগুলো করা যেতে পারে।

দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি বা কয়েল ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে রাতে শোয়ার আগে অবশ্যই মশারী টানিয়ে ঘুমাতে হবে।
বাড়িঘর ও এর আশপাশে যাতে মশা বংশবৃদ্ধি করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
জমা পানিতে মশা ডিম পাড়ে বেশি। তাই ঘরের আশপাশে কোথাও অবাঞ্ছিত পানি জমতে দেওয়া যাবে না। এসব স্থানে কীটনাশক বা কেরোসিন ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
ম্যালেরিয়া মশা মুলত সন্ধ্যা থেকে ভোরের মধ্যে কামড়ায়। তাই সন্ধ্যা থেকে শোয়ার আগে শরীরের খোলা অংশগুলোতে মশা তাড়ানোর ক্রিম লাগানো যেতে পারে।
দরজা-জানালায় মশক নিরোধক জাল, প্রতিরোধক ক্রিম, স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
মশারি ব্যবহার না করলে মশা তাড়ানোর ধুপ ও ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে।
ওষুধ খেয়ে ম্যালেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পদ্ধতিটি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয়। কোনো অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব থাকলে এবং ঐ ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায় বেড়াতে গেলে যাবার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ক্লোরোকুইন জাতীয় ঔষধ সেবন করে যাওয়া উচিত।

পড়ুন  যাদের সিজার করে সন্তান হয়েছে, তারা অবশ্যই জেনে রাখুন এসব তথ্য

ম্যালেরিয়া আমাদের কারও কাছে এখন অপরিচিত কোনো রোগ নয়। রোগটি নিরাময়যোগ্য ও প্রতিরোধযোগ্য। তবে ক্ষেত্রবিশেষে জীবনঘাতী হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত রোগটি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবেই রয়ে গেছে। তাই সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। তাই ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায় ভ্রমণের আগে অবশ্যই প্রতিরোধমূলক ওষুধ খেয়ে নেওয়া জরুরি। গত ছয় বছরে বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূল করতে সরকারের পাশাপাশি সব স্তরের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে।

ফেসবুক কমেন্ট

comments

About পূর্ণিমা তরফদার

আমি পূর্ণিমা তরফদার আপনার ডক্টরের নতুন রাইটার। আশাকরি আপনার ডক্টরের নিয়ামিত পাঠকরা আমাকে সাদরে গ্রহণ করবেন ও আমার পোষ্টগুলো পড়বেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.