...

অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত ঘটে যে সকল কারণে

গর্ভধারণ করা প্রত্যেক নারীর জন্যই অত্যন্ত আনন্দের একটি বিষয়। সন্তানকে গর্ভে ধারন করার পর প্রসবকাল পর্যন্ত চল্লিশ সপ্তাহের এই লম্বা যাত্রায় অনুর সমান ভ্রুন থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ শিশুর অবয়ব ধারন করা পর্যন্ত গর্ভস্থ সন্তান পরিবর্তিত হয় নানান ভাবে, আস্তে আস্তে পরিণত হয় একজন সম্পূর্ণ মানুষে। কিন্তু গর্ভধারণের এই সময়ের মধ্যে যদি কোন কারণে গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু হয় বা ভ্রুন নষ্ট হয়ে যায়, তবে তাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত। ভ্রূণের বয়স ১ দিন হোক বা ১ মাস, সন্তান হারানো সব সময়ই চরম কষ্টের একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায় । সমস্ত পরিবার, বিশেষ করে পিতা মাতার জন্য বিষয়টি অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়ে উঠে। একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভপাত কেন হলো, সেই কারণটা মানুষ ভেদে অবশ্যই আলাদা হবে। তবে গর্ভপাত হবার বেশ কিছু কারণ আছে। আসুন জেনে নেই সেগুলো সম্পর্কে-অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত

অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত ঘটে যে সকল কারণে

পিতামাতা বা গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক ক্রুটি-
অনেক সময়ে গর্ভস্থ শিশু, বা তার মা/বাবার অথবা দুই পক্ষেরই শারীরিক কোনো ক্রুটি থাকতে পারে যার কারণে গর্ভপাত হয়ে যায়। অন্তঃসত্ত্বা মায়ের যদি হাইপ্রেসার বা ডায়াবেটিস থাকে তবে গর্ভপাতের একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। আবার অনেক সময় রক্তে সংক্রমণের ফলে বা জরায়ুতে সংক্রমণের ফলে, কিংবা জরায়ুতে টিউমার বা সিস্ট থাকলে গর্ভপাত হবার সম্ভাবনা থাকে। আবার অনেকের জরায়ুতে সন্তান ধারন করার মত যথেষ্ট জায়গা থাকেনা, কিংবা অনেকের সন্তান ধরে রাখার মত শারীরিক সক্ষমতাও থাকেনা। ফলে গর্ভপাত হয়ে যায়। আবার গর্ভাবস্থায় সন্তানের সুস্থ ও সঠিকভাবে বৃদ্ধি পাবার জন্য মায়ের গর্ভে যে থলি তৈরি হয় তাতে যদি যথেষ্ট পরিমাণ পানি না থাকে, তার ফলেও গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু হতে পারে। তাছাড়া অনেকের প্রসবের সময় পেরিয়ে গেলে জরায়ুর পানি কমতে থাকে। পানি কমে যাবার ফলে গর্ভস্থ শিশু দুর্বল হয়ে যায় এবং মারা যায়। আবার অনেক গর্ভস্থ শিশুর মাথা বড় বা শরীরের কোন অংশ ঠিকমত গঠিত হয় না। তখনও গর্ভপাত ঘটতে পারে।

পড়ুন  গরমে ভাইরাস জ্বর

নানা রকমের জৈবিক ত্রুটি-
গর্ভপাতের আরো অনেক কারণের মাঝে নানা রকমের জৈবিক ক্রুটিও একটি অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত হয়। যেমন- অনেকের জেনেটিক ডিফেক্ট, ক্রোমজমের অ্যাবনরমালিটি বা হরমোনাল ডিফেক্ট ইত্যাদি থাকতে পারে। এসবের ফলেও গর্ভস্থ সন্তান সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারেনা, ফলে গর্ভপাত হয়ে যায়। এছাড়াও দুইটি হরমোন প্রজেস্টোরন ও এইচসিজি মায়ের জরায়ুকে গর্ভধারণের সময়ে শান্ত রাখতে সাহায্য করে, যেন মা’কে অসময়ে প্রসব থেকে রক্ষা করা যায় এবং সন্তান সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু যদি এই দুই হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায় বা বা কমে যায় তখন গর্ভপাত হতে পারে। আবার হবু মায়ের শরীরে যদি থাইরয়েড হরমোন কম থাকে, তাহলেও বাচ্চা গর্ভে মানিয়ে নিতে পারেনা। ফলে গর্ভপাত হয়। এছাড়া আছে প্রোলাক্টিন নামে আরো এক রকম হরমোন আছে। মায়ের শরীরে এই হরমোন বেশি থাকলেও হতে পারে গর্ভপাত।

নানা ধরনের সংক্রমণ-
সিফিলিস,টোপস্নাজমোসিস ধরনের সংক্রামক ব্যধির কারণে বার বার গর্ভপাত ঘটে। টোপস্নাজমিক রোগের জীবাণু টোপস্নাজম নামক এক কোষী পরজীবী প্রাণী যা প্রতিকূল পরিবেশেও ছয়-সাত মাস বেঁচে থাকে। এই জীবাণু খাদ্য বা পানীয়ের সাথে শরীরে প্রবেশ করলে টোপস্নাজমা রোগ হয়। এ রোগে আক্রান্ত প্রসূতিদের বার বার গর্ভপাত হবার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও জন্মাতে পারে অন্ধ,শারীরিক প্রতিবন্ধী বা মৃত শিশু। আবার গর্ভবতী নারী যদি ম্যালেরিয়া বা নিউমোনিয়া জাতীয় রোগের সংক্রমণের শিকার হন বা হয়ে থাকেন তবে তা থেকে গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও জরায়ুতে ক্রনিক ইনফেকশনের কারনেও জরায়ুতে বাচ্চা ধরে রাখা সম্ভব হয় না, ফলে গর্ভপাত হয়।

পড়ুন  আঁচিল দূর করার ৭টি কার্যকরী ঘরোয়া উপায়

দুর্বল শুক্রাণু, ডিম্বাণু ও অন্যান্য গঠনমূলক সমস্যা-
গর্ভপাত হবার অন্যতম প্রধান কারণ হল খুঁতযুক্ত ডিম্বানু বা শুক্রানু। ডিম্বাণু বা শুক্রাণুর কোন এক্নটি যদি দুর্বল হয় তবে সেই ভ্রুন ক্রুটিপুর্ন হবে। আর ভ্রূণ ক্রুটিপূর্ণ হলে গর্ভচ্যুত হবে। এছাড়াও দুর্বল শুক্রাণু ডিম্বাণু থাকলে অস্বাভাবিক ভ্রূণ তৈরি হবে, যা এক পর্যায়ে গিয়ে নিজে থেকেই মানিয়ে নিতে না পেরে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে গর্ভপাত ঘটে। এছাড়াও ক্রোমজম বা জীণ ঘটিত কোনও কারণে যদি ভ্রূণ সঠিকভাবে গঠিত না হয় তাতেও গর্ভপাত হতে পারে। এছাড়া যদি মায়ের অটোইউমন প্রসেস দুর্বল হয় তবে হতে পারে গর্ভপাত।

জরায়ুর মুখের কার্যহীনতা ও অন্যান্য সমস্যা-
গর্ভধারণের পরে জরায়ু মুখের প্রধান কাজ হল ভ্রূণকে গর্ভের ভেতরে ঠিকভাবে ধরে রাখা। কোন কারণে যদি জরায়ুর মুখ বড় হয়ে যায় তাহলে ঘটে বিপত্তি। তখন ভ্রূণ বড় হয়ে সুগঠিত হতে থাকলে জরায়ুমুখের পক্ষে আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না ভ্রূণকে। ফলে গর্ভপাত হয়। আবার অনেক সময় পূর্বে গর্ভপাত করানো হয়ে থাকলেও জরায়ুর মুখের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে হতে পারে গর্ভপাত। আবার কারো জন্মগতভাবে যদি অস্বাভাবিক জরায়ু থেকে থাকে বা প্রজননতন্ত্রের গঠন সঠিক না হয়ে থাকে তবে গর্ভধারণে অসুবিধা দেখা দেয় বা গর্ভধারণ হলেও গর্ভপাতের সম্ভাবনা থেকে যায়। এছাড়াও নিষেকের পরে ভ্রূণ যদি জরায়ুতে সঠিকভাবে স্থাপিত না হয় তবেও হতে পারে গর্ভপাত।

পড়ুন  জেনে নিন সর্বোচ্চ ভিটামিন সি যুক্ত ১০টি খাবারের তালিকা

মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা-
অনেক সময় নানা ধরনের মানসিক সমস্যার কারনের ঘটে যেতে পারে গর্ভপাত। গর্ভধারণ করার পরে মা যদি অত্যধিক টেনশন করেন, তবে এই টেনশনের ফলে হতে পারে গর্ভপাত। এছাড়াও অতিরিক্ত স্ট্রেস থেকে হতে পারে উচ্চরক্তচাপের সমস্যা যা গর্ভপাতের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত। এছাড়াও গর্ভকালীন সময়ে মা বিষাদের শিকার হলে তা সরাসরি সন্তানের উপরে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে, ফলে গর্ভপাত হতে পারে।

ধূমপান, মদ্যপান ও অন্যান্য নেশা করার অভ্যাস-
মা যদি সিগারেট, এলকোহল বা অন্য কোনও নেশায় আসক্ত থাকেন; তাহলেও ঘটে যেতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত। একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে গেলে মাকে অবশ্যই সুস্থ ও নেশামুক্ত শরীরের অধিকারী হতে হবে। এছাড়াও অনেক সম অয় অনেক পরিস্থিতিতেই ঘটে যেতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত। অতিরিক্ত পরিশ্রম বা অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার ফলেও গর্ভপাত হতে পারে। দুর্ঘটনা হয়ত এড়ানো সম্ভব না, কিন্তু অন্য সবকিছুর জন্য আছে নান ধরনের প্রতিকার যা ঠিকভাবে পালন করলে গর্ভপাত এড়ানো সম্ভব। সন্তানকে ধরা হয় সৃষ্টিকর্তার অমূল্য দান হিসেবে। কিন্তু এখনো আমাদের মাঝে নিঃসন্তান দম্পতিকে করুনার চোখে দেখার অভ্যাস পরিবর্তিত হয়নি। অথচ আমরা একবারও চিন্তা করে দেখিনা তাদের অবস্থায় আমরা নিজেরা থাকলে কি হতো। অনেকে আছেন যারা কোন ক্রুটির কারণে সন্তান জন্মদানে সক্ষম নন। কিন্তু যদি কেউ সক্ষম হন কিন্তু কোন সমস্যায় জর্জরিত থাকেন, তাহলে দেরি না করে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে সঠিক চিকিৎসা নিন, এবং গর্ভপাতের ঝুঁকি কমিয়ে সুস্থ ও সবল সন্তানকে নিয়ে আসুন এই পৃথিবীতে।

ফেসবুক কমেন্ট

comments

About পূর্ণিমা তরফদার

আমি পূর্ণিমা তরফদার আপনার ডক্টরের নতুন রাইটার। আশাকরি আপনার ডক্টরের নিয়ামিত পাঠকরা আমাকে সাদরে গ্রহণ করবেন ও আমার পোষ্টগুলো পড়বেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.