...

শিশুর দাঁতের যত্ন। কখন থেকে ও কিভাবে?

শিশুদের দাঁত ও মাড়ির যত্নে অবহেলার কারণে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আপনার ছোট্ট শিশুটির দাঁত উঠার আগে ও পরে চাই যত্ন ও পরিচর্যা। আমাদের দেশের শিশুরা প্রায়ই দাঁত ও মাড়ির সমস্যায় ভোগে অথচ শিশুর দাঁতের যত্ন প্রাত্যহিক যত্নের মধ্যে পরে যার অভ্যাস শিশুদের খুব ছোটবেলা থেকেই শেখানো বা শিখিয়ে গড়ে তোলা প্রয়োজন। শিশুদের দাঁতের যত্ন নিতে হয় শুরু থেকেই কারন গর্ভেই শিশুর দাঁত উঠা শুরু করে আর সাধারনত তা ছয় মাস বয়সে দৃষ্টিগোচর হয় । কোমলমতি শিশুদের দাঁতের যত্ন নেওয়া শেখাতে পিতা মাতার ভূমিকাই প্রথম এবং যা তাদের অন্য সকল শিক্ষার সাথে ছোট কালেই শেখানো খুব প্রয়োজন।শিশুর দাঁতের যত্ন

শিশুর দাঁতের যত্ন। কখন থেকে ও কিভাবে?

শিশুদের প্রথম দাঁত উঠার সময়টি খুবই গুরত্বপূর্ণ। এসময় পর্যাপ্ত যত্ন ও সতর্কতা অবলম্বন করাই পারে শিশুকে ভবিষ্যতে সুন্দর ও রোগ মুক্ত দাঁতের নিশ্চয়তা দিতে। অনেকেই ভাবতে পারেন প্রথম যে দাঁত উঠে সেগুলো তো কিছুদিন পরে পড়ে যায়, তাহলে এতো যত্ন নেয়ার প্রয়োজন কি? এটা খুবই ভুল ধারণা। মনে রাখবেন, প্রতিটি দাঁতই মূল্যবান। এসময় দাঁতের যত্নে অবহেলা করলে দাঁতে জীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে। শুধু তাই নয়, প্রথম উঠা দাঁতগুলো যদি দ্রুত পড়ে যায়, তবে প্রাপ্ত বয়সে দাঁত পুনরায় উঠার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে এবং শিশুর কথা বলার ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই দাঁত উঠার আগে থেকেই শিশুর মুখ ও ভবিষ্যৎ দাঁতের ক্ষেত্রে যত্নবান হতে হবে।

দাঁত উঠার প্রারম্ভে
শিশুদের দাঁত উঠার প্রাথমিক সময়সীমা হচ্ছে ৬-১২ মাস বা শিশুর জন্মের ১ বছর বয়সের মাঝে। তবে সাধারণ ভাবে গড়ে ৬ মাস বয়সের মাঝেই অধিকাংশ শিশুর দাঁত উঠে যায়। শিশু যখন মায়ের জরায়ুতে অবস্থান করে তখন থেকেই তার দাঁত গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। তাই এসময় মায়েরা যে খাবারের সাথে যে ভিটামিন ও খনিজ উপাদান ( ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস) গ্রহণ করেন, তা তার গর্ভস্থ্য শিশুর ভবিষ্যৎ দাঁত গঠনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

যা লক্ষ্য রাখবেন
শিশুদের প্রথম যখন দাঁত উঠে তখন মাঢ়ির যেখানে দাঁত উঠে সেই জায়গাটি বিবর্ণ বা লালচে হয়ে যেতে পারে। এছাড়া সেই জায়গাটি কিছুটা ফুলে যেতে পারে। তবে দাঁত উঠার সাথে সাথে এ ব্যপারগুলো আর থাকে না।

যা করণীয়
হাতের আঙ্গুল বা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে শিশুর মুখ ও মাঢ়ি নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন।দাঁত না থাকলেও নবজাতক শিশুর মুখ ও মাড়ি পরিষ্কার রাখা উচিত| নতুন দাঁত উঠার আগে মাঢ়ির সেই জায়গাতে ছোট গর্ত তৈরি হতে পারে। এখানে ব্যাক্টেরিয়া লুকিয়ে থাকতে পারে ও রোগ সংক্রমণ করতে পারে। এটা প্রতিদিন সকালে খাবারের আগে ও রাতে ঘুমাতে যাবার আগে করুন, যাতে আপনার শিশু দাঁত ব্রাশ করার অভ্যাসটিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।

পড়ুন  ওজন কমিয়ে ফেলুন এবার ঘুমিয়ে

শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর শেষে পাতলা সুতি কাপড় অথবা তুলা দিয়ে মাড়ির ওপর থেকে দুধের আবরণ পরিষ্কার করে দিন আর খেয়াল রাখবেন তা যেন অবশ্যই পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত হয়। দাঁত উঠার আগে শিশু যা কিছু সামনে পায় সেটাই কামড়াতে চায়, তখন তাকে বেবি টিথার দিতে পারেন যা কামড়ানোর ফলে তার দাঁতের গঠন শক্ত হবে। এই সময় শিশুর হাতের কাছ থেকে বিষাক্ত, ধারালো, নোংরা জিনিস বা ওষুধপত্র দূরে রাখুন আর এমন কিছু দেবেন না যা গিলে ফেললে তার গলায় আটকে যেতে পারে।

শিশুর প্রথম দাঁত উঠার ৬ মাস পরই দন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বিশেষ করে যারা পেডিয়াট্রিক ডাক্তার ও শিশুদের দাঁতের চিকিসার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ তাদের পরামর্শ নিতে চেষ্টা করুন।

দাঁত উঠার পরে
আপনার শিশুর প্রথম জন্মদিনের মাঝেই তার মুখে বেশ কয়েকটি দাঁত উঠে যাবার কথা। সাধারণ ভাবে অন্তত ৮ টি দাঁত। যদি ১৮ মাস বয়সেও আপনার শিশুর দাঁত না উঠে, তবে চিন্তিত না হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে ডাক্তাররা শিশুদের মাঢ়িতে হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঘষা বা rub করতে বলেন, যাতে দাঁত উঠার ব্যপারটা সহজ হয়।

শিশুর দুধ দাঁত গুলোর যত্নে আপনার আরো বেশি খেয়াল রাখা দরকার কারণ দুধদাঁত গুলো সাধারনত সাত থেকে এগারো বছর বয়স পর্যন্ত ধীরে ধীরে পড়ে গিয়ে আবার নতুন করে স্থায়ী ভাবে জন্মায়। শিশুদের পরবর্তী স্থায়ী দাঁতগুলোতে যেন কোন সমস্যা না হয় সেজন্য তার দুধদাঁত গুলোর যত্ন নেয়া অনেক গুরুত্বপুর্ন। অযত্ন ও অবহেলার কারনে দুধ দাঁতের শিকড়ে প্রদাহ অনেক দিন স্থায়ী থাকলে স্থায়ী দাঁতের ক্ষতি হয়। এমন অনেক কারনেই স্থায়ী দাঁতগুলো আঁকাবাঁকা বা অসমানভাবে বেড়ে উঠে। এই জন্য দুধদাঁত পড়া ও স্থায়ী দাঁত ওঠার সময়ে শিশুর দাঁতের বিশেষ যত্নের প্রয়োজন।

যা লক্ষ্য রাখবেন
শিশুর যে কয়টি দাঁত উঠুক না কেন, সেগুলোর অবস্থান কিভাবে রয়েছে তা লক্ষ্য করুন। অর্থাৎ শিশুর দাঁত ফাঁকা ফাঁকা বা ঘন সন্নিবেশিত কিনা। শিশুকে দাঁতে এসময় “ফ্লস” করাতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে ডেন্টাল ফ্লসিং কিভাবে করাবেন সে বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

নতুন দাঁত উঠলে শিশুরা দাঁতে দাঁতে ঘষা লাগিয়ে আনন্দ পায়, কারণ এরকম করলে মুখের মাঝে শব্দ সৃষ্টি হয়। ব্যপারটা তাদের কাছে অনেকটা খেলার মতো। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এটা শিশুর দেহে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির নির্দেশক ও বটে। হতে পারে সে ক্লান্ত, কিংবা ঠান্ডা বা গরম অনুভব করছে অথবা সর্দি লেগেছে। এগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখুন।

পড়ুন  মুখের দুর্গন্ধ দূর করার সবচেয়ে সহজ উপায়

যা করণীয়
দাঁত উঠলে শিশুকে শুরুতেই দাঁত ব্রাশ করা শেখাতে হবে। শিশুকাল থেকেই দাঁত ব্রাশের অভ্যাস গড়ে তুলতে শিশুর বাবা মা তার সামনে ব্রাশ করলে তার আগ্রহ অনেক বাড়ে আর অনুকরণ প্রিয় হওয়ার কারনে তারা খুব জলদি শেখে। তাই দাঁত ওঠার শুরুতেই আপনার শিশুর হাতে কোমল ও নরম একটা ব্রাশ তুলে দিন। অবশ্যই তার জন্য বেবি জেল বা পেষ্ট ব্যবহার করবেন কারন তা গিলে ফেললেও সমস্যা নেই আর বড় হওয়ার সাথে সাথে তাকে সঠিক পদ্ধতিতে ব্রাশ করা শেখান।

মা-বাবাকেই ব্রাশ করিয়ে দিতে হবে। শিশুর ব্রাশ হবে ছোট। ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করতে হবে। ফ্লোরাইড দাঁতের ক্ষয়রোধ করে। ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট সবচেয়ে ভালো, কারণ এটি দাঁতের আবরণ এনামেল গঠনে সাহায্যে করে। তবে খেয়াল রাখতে হবে শিশু যেন টুথপেস্ট খেয়ে না ফেলে। আমেরিকান একাডেমী অফ পেড্রিয়াট্রিক ডেন্টিস্ট্রি এর মতে দুইবছর বয়সের পূর্বেই শিশুদের সামান্য পরিমান ক্যাভিটি প্রতিরোধক ফ্লোরাইড টুথপেস্ট দেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে খুবি কম পরিমান, যেমন চাল পরিমান পেস্ট ছোট শিশুদের এবং মটরদানা/ছোলা পরিমান পেস্ট তিন বছরের বাচ্চাদের দিতে পারেন। ব্রাশিং এর সময়ে যদি বাচ্চা সামান্য পরিমান পেস্ট খেয়েও ফেলে সেটা নিয়ে চিন্তিত হবার কিছু নাই কারণ তা দাঁতের জন্য ক্ষতিকর না। দুই বছরের শুরু থেকে আপনার শিশু কে ব্রাশিং এর সময়ে থুথু ফেলতে শেখানো শুরু করুন।

শিশুর টুথব্রাশ অবশ্যই হতে হবে নরম ও কোমল। দাঁত ব্রাশ করার কিছুক্ষন আগে ব্রাশটি কিছুক্কন গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ব্রাশের ব্রিসল আরও নরম হয়ে যাবে। আর খেয়াল রাখতে হবে যেন ব্রাশ এর মাথাটা খুব ছোট হয়।এসময় নতুন দাঁত উঠার কারণে যদি শিশু কান্নাকাটি করে বা মুখে ব্যথা অনুভব করে, তবে হাতের আঙ্গুল বা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে তার দাঁত ও মাঢ়ি পরিষ্কার করে দিন।

ঐতিহ্যগতভাবে আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করি। এতে কোনো ভালো ফল পাওয়া যায় না। রাতে খাবারের পর খাদ্যকণা জমে থাকলে তাতে সহজেই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে দাঁত ক্ষয় করতে পারে।ব্রাশ করতে হবে দিনে কমপক্ষে দুইবার। রাতে খাবারের পর ও দিনে সকালের নাস্তার পর। শিশুকেও এভাবেই ব্রাশ করা শেখাতে হবে। ব্রাশ করতে হয় ১-২ মিনিট। সব দাঁতে যেন ব্রাশ পৌঁছে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। উপর ও নিচে ব্রাশ করতে হবে। ব্রাশের উল্টো পিঠ দিয়ে জিহ্বা ও তালু পরিষ্কার করতে হবে।আর অবশ্যই ব্রাশ করার পর তাকে কুলি করার জন্য গ্লাসে বা মগে ফুটিয়ে ঠান্ডা করা খাবার পানি দিন, কলের পানি নয়।শিশু ঠিকমতো দাঁত ব্রাশ করছে কি না তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তিন বছর বয়স পর্যন্ত এভাবে শিশুর দাঁত ব্রাশ করিয়ে দিতে হবে।

পড়ুন  দাঁতের পাথর দূর করুন ডেন্টিস্ট ছাড়াই সবচেয়ে কার্যকরী উপায়ে ঘরে বসে নিজেই

এক টুথব্রাশ ২-৩ মাসের বেশি ব্যবহার না করাই ভালো। অনেক শিশুর দাঁতে হলদে ভাব দেখা যায়। বিভিন্ন ওষুধ ও অতিরিক্ত ফ্লোরাইডের কারণে তা হয়। দন্ত্য চিকিৎসককে দাঁত দেখানোর কথা আমরা ভুলে যাই। আমেরিকান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন বলেছে প্রথম জন্মদিনের আগেই শিশুকে দন্ত্য চিকিৎসককে দেখাতে হবে। এরপর বছরে অন্তত দুইবার দন্ত্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। দাঁতে ব্যথা, কালচে বা হলুদ ভাব আসলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

শিশুর দাঁতের যত্নে আরও কিছু টিপস
শিশুর জন্মের পর ছয় মাস পর্যন্ত কেবল মায়ের বুকের দুধই একমাত্র আদর্শ খাদ্য, এটা সবাই জানেন। অনেক মা শিশুকে ফিডারে কৌটার দুধ, কখনো স্বাদ বাড়ানোর জন্য চিনি মিশিয়ে দিয়ে থাকেন। এটা শিশুর পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের জন্য তো খারাপই, দাঁতের জন্যও খারাপ। এতে নতুন দুধদাঁতেও ক্যারিজ বা ক্ষয় হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় আপনি সতর্ক থাকুন। খেয়াল রাখুন আপনার স্তন এবং হাত যেন পরিস্কার থাকে।জন্মানোর পর থেকে যতদিন বুকের দুধ না ছাড়ে সে পর্যন্ত বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করুন। দুধের স্তর মাড়িতে শুকিয়ে শিশুর মাড়িতে ইনফেকশান হয়ে যেতে পারে। তাই নরম কাপড় দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার করা উচিত।

শিশুরা মিষ্টি জাতীয় খাবারের ভক্ত। অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবারই দাঁতের সমস্যার মূল কারণ। মিষ্টি খেলে মুখে ব্যাকটেরিয়া হয় বেশি। নিয়মিত দাঁত ব্রাশ না করলে দাঁতের ফাঁকে খাদ্যকণা জমে যায়। এ খাদ্যকণা ও ব্যাকটেরিয়া দাঁতের চারপাশে প্লাক তৈরি করে। প্লাকের ব্যাকটেরিয়া মিষ্টি জাতীয় খাবারকে এসিডে পরিণত করে। যে কারণে দেখা দেয় দাঁতের ক্ষয়। এজন্য শিশুদের মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশি খেতে দেয়া যাবে না। চকলেট অথবা চিনিজাতীয় খাবার খেয়ে মুখ পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা শিখান আপনার শিশুকে।

এত কিছুর পরে দুধ দাঁতের কোনো সমস্যা হলে অভিজ্ঞ ডেন্টিস্টের পরামর্শ নেওয়া ভালো। বছরে অন্তত দু’বার ডাক্তার দেখানো উচিত। শিশুর দুধ দাঁত নড়ে গেলে তা টেনে তোলা উচিত নয়, হালকা নড়লে যদি উঠে ভালো, নয়তো নিকটস্থ ডেন্টিস্টের কছে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। নড়ে যাওয়া দাঁত মাটিতে পুঁতে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। এর সঙ্গে সুন্দর দাঁতের কোনো সম্পর্ক নেই।

ফেসবুক কমেন্ট

comments

About পূর্ণিমা তরফদার

আমি পূর্ণিমা তরফদার আপনার ডক্টরের নতুন রাইটার। আশাকরি আপনার ডক্টরের নিয়ামিত পাঠকরা আমাকে সাদরে গ্রহণ করবেন ও আমার পোষ্টগুলো পড়বেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.