...

জন্ডিস থেকে বাঁচতে

জন্ডিসের মাত্রা বেশি হলে হাত, পা, এমনকি পুরো শরীর হলুদ হয়ে যেতে পারে। তবে জন্ডিসের কারণে মৃত্যু হয় কি না তা নির্ভর করে জন্ডিসের ভয়াবহতার ওপর। জন্ডিস হলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায় (রক্তে বিলিরুবিনের ঘনত্ব ১.২ মিগ্রা/ডিএলের নিচে থাকে। ৩ মিগ্রা/ডিএলের বেশি হলে জন্ডিস হয়েছে ধরা হয়) এবং এ সময় ত্বক, চোখের সাদা অংশ এবং অন্যান্য মিউকাস ঝিল্লি হলুদাভ হয়।জন্ডিস

জন্ডিস থেকে বাঁচতে

ধরন
পরিণত বয়সী যে কারো জন্ডিস হতে পারে। বিভিন্ন কারণে নবজাতকেরও জন্ডিস হয়। রক্তে কী ধরনের বিলিরুবিন বেড়ে যাচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে কারণগুলো দুই ভাগে ভাগ করা যায়। আনকনজুগেটেড হাইপারবিলিরুবিনেমিয়া ও কনজুগেটেড হাইপারবিলিরুবিনেমিয়া।

রক্তে আনকনজুগেটেড বিলিরুবিন বাড়ার উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো— ফিজিওলজিক জন্ডিস, ব্রেস্ট মিল্ক জন্ডিস, এ বি ও ব্লাড ইনকমপ্যাটিবিলিটি, কনজেনিটাল হিমোলাইটিক অ্যানেমিয়া ও ক্রিগলার ন্যাজার সিনড্রোম। রক্তে কনজুগেটেড বিলিরুবিন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণগুলো হলো—নবজাতকের লিভার প্রদাহ (নিওনেটাল হেপাটাইটিস সিনড্রোম) এবং বিভিন্ন বংশগত লিভার রোগ (যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—বিলিয়ারি এট্রেসিয়া, ফ্যামিলিয়াল ইনট্রাহেপাটিক কোলেস্ট্যাসিস ও আলফা-ওয়ান এনটাইট্রিপসিন ডিফিসিয়েন্সি)। এ ছাড়া হাইপোথাইরয়েডিজম এবং হাইপোপিটুইটারিজম রোগে কনজুগেটেড ও আনকনজুগেটেড—দুই ধরনের বিলিরুবিনই রক্তে বাড়তে পারে।

ফিজিওলজিক জন্ডিস : নবজাতকের রক্তে বিলিরুবিন বেড়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ফিজিওলজিক জন্ডিস। এটিও কোনো রোগ নয়। জন্মের পর নবজাতকের লিভারের বিলিরুবিন প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং নিঃসরণ পদ্ধতির পূর্ণতা অপেক্ষাকৃত দেরিতে হয়। এ সময় অনেক শিশুর লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যে বিলিরুবিন তৈরি হয়, তা লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়ে শরীরের বাইরে বের হতে পারে না। রক্তের এই অতিরিক্ত বিলিরুবিনের কারণে গায়ের রং হলুদ হয়ে যায়। সাধারণত জন্মের পর তৃতীয় দিন থেকে এ সমস্যা হতে পারে এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে এটি একা একাই কমে যায়। ফিজিওলজিক জন্ডিসে সাধারণত বিলিরুবিনের মাত্রা সর্বোচ্চ ১৩ মিগ্রা/ডিএল পর্যন্ত উঠতে পারে। এই সীমা অতিক্রম করলে অন্য কোনো কারণে জন্ডিস হয়েছে কি না সন্দেহ করা হয়। পঞ্চম দিন থেকে বিলিরুবিন এমনিতেই কমে যেতে থাকে। সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহের মধ্যে বিলিরুবিনের মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে রক্তে বিলিরুবিন ১৭ মিগ্রা/ডিএল অতিক্রম করলে ফটোথেরাপি এবং ২০ মিগ্রা/ডিএল অতিক্রম করলে এক্সচেঞ্জ ট্রান্সফিউশন প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা করা হয়।

পড়ুন  ক্যান্সার প্রতিরোধে রসুনের আশ্চর্য কেরামতি জেনে নিন

ব্রেস্ট মিল্ক জন্ডিস : শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর (এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং) ফলে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ কোনো কোনো নবজাতকের জন্মের পর চতুর্থ দিন থেকে জন্ডিস দেখা দিতে পারে। একে বলে ব্রেস্ট মিল্ক জন্ডিস। প্রতি ১০০ জনে একজন নবজাতকের ব্রেস্ট মিল্ক জন্ডিস হতে পারে। এ ধরনের জন্ডিসে জন্মের পর চতুর্থ দিন থেকে সপ্তম দিনে গিয়ে রক্তে বিলিরুবিন সর্বোচ্চ মাত্রায় বেড়ে তারপর কমতে শুরু করে। এক থেকে দুই মাস পর্যন্ত অল্প মাত্রার জন্ডিস থেকে যেতে পারে। তবে এটি শরীরের কোনো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না।

চিকিৎসা
জন্ডিসের চিকিৎসা সাধারণত নির্ভর করে ঠিক কী কারণে জন্ডিস হলো তার ওপর। এ জন্য জন্ডিসের উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই একজন লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসক শারীরিক লক্ষণ এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জন্ডিসের তীব্রতা ও কারণ নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। শিশুদের জন্ডিস হলে অনেক সময় হাসপাতালে ভর্তি করে বিভিন্ন থেরাপিও প্রয়োগ করতে হয়। গ্রামগঞ্জে জন্ডিসের অনেক অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা প্রচলিত। এসব চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত নয়। এতে লিভারসহ শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

পড়ুন  মেদ কমানোর ১০টি সহজ উপায় ব্যায়াম ছাড়াই

কিছু ভুল ধারণা
জন্ডিস নিয়ে অনেকেরই ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, জন্ডিসের রোগীকে হলুদ দিয়ে রান্না করা খাবার দেওয়া যাবে না। তাঁদের ধারণা, হলুদ দিয়ে রান্না করা খাবার খেলে চোখ, শরীর ও প্রস্রাব আরো হলুদ হবে এবং জন্ডিস বেড়ে যাবে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। জানা রাখা দরকার যে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় শরীর হলুদাভ হয়। আর খাওয়ার হলুদ একটি প্রাকৃতিক উপাদান। এই হলুদে রয়েছে মূলত শর্করা, ক্যালসিয়াম, লৌহ ও ক্যারোটিন। এসব উপাদান জন্ডিসের রোগীর কোনো ক্ষতি করার কথা নয়।

শুধু হলুদ নয়, অন্যান্য মসলাযুক্ত খাবার খেতেও বারণ করেন অনেকে। এটিও ভুল। জন্ডিসের রোগীরা স্বাভাবিক সব ধরনের খাবার যেমন—মাছ, মুরগির মাংস, ডাল, শাকসবজি ইত্যাদি (স্বাভাবিক রান্না করা) খেতে পারবে। স্বাভাবিক খাবার না দিলে রোগী বরং আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে জন্ডিস হলে মুখের রুচি বা স্বাদ চলে যায় বলে রুচিকর যেকোনো খাবারই রোগীকে খেতে দেওয়া উচিত।

জন্ডিস হলে শুধু আখের রস খেতে হবে—এমন ধারণাও অনেকে পোষণ করেন, যা ঠিক নয়। বরং শুধু আখের রস বারবার খেতে থাকলে একপর্যায়ে পেট ফেঁপে অন্য সমস্যা তৈরি হতে পারে।

পড়ুন  অতিরিক্ত খাবার আসক্তি কমিয়ে ফেলুন এই চমৎকার ৪টি কৌশলে

প্রতিরোধে করণীয়
জন্ডিসের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। প্রতিরোধই এ রোগ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। এ জন্য কিছু করণীয় হলো—

► সব সময় বিশুদ্ধ খাদ্য খাওয়া ও পানি পান।

► শরীরে রক্ত নেওয়ার দরকার হলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং করে নেওয়া। বিশেষ করে এ কাজে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করা খুব জরুরি।

► মদ্যপান বা সব ধরনের নেশাদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।

► কলকারখানার রাসায়নিক পদার্থ থেকে দূরে থাকা।

► ব্যবহৃত ইনজেকশন কিংবা নাক-কান ফোঁড়ানোর কাজে সুই ব্যবহার না করা।

► সেলুনে বা বাড়িতে শেভ করতে আগে ব্যবহার করা ব্লেড বা ক্ষুর আবার ব্যবহার না করা উচিত।

► নিরাপদ যৌনমিলনের দিকে বিশেষ সতর্ক থাকা।

► জন্ডিস হলে টিকা নিলে কোনো লাভ হয় না। তাই সুস্থ থাকতে আগেই টিকা নিতে হবে। হেপাটাইটিস ‘বি’র ক্ষেত্রে প্রথম মাসে একটি, দ্বিতীয় মাসে একটি বা ছয় মাসের মধ্যে একটি ডোজ দেওয়া হয়। হেপাটাইটিস ‘এ’র ক্ষেত্রে একটি ডোজই যথেষ্ট। আর দুই ক্ষেত্রেই পাঁচ বছর পর পর বুস্টার টিকা দেওয়া হয়।

ফেসবুক কমেন্ট

comments

About পূর্ণিমা তরফদার

আমি পূর্ণিমা তরফদার আপনার ডক্টরের নতুন রাইটার। আশাকরি আপনার ডক্টরের নিয়ামিত পাঠকরা আমাকে সাদরে গ্রহণ করবেন ও আমার পোষ্টগুলো পড়বেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.